করোনা ভাইরাস

পুরো পৃথিবী আজ লকড-ডাউন। শহরগুলিতে রিক্ততার বাতাস বয়ে চলছে। দিন কে দিন মহামারী (কভিট-১৯) করোনা ভাইরাসে পৃথিবীর কোন না কোন প্রান্তে ঝরছে কত প্রাণ। আক্রান্ত হচ্ছে হাজারে হাজারে মানুষ। এ যেন বাতাসের বেগে সর্বত্র ছড়িয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তি, ক্ষমতা আর সচেতন জনশক্তি নিয়েও পৃথিবীর উন্নত দেশগুলি এই ভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান যে ভাইরাসের এই পর্যন্ত কোন প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারেনি। আমরা..? করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে লোকজনের মধ্যে বিভিন্ন বস্তু ধরার বিষয়ে তাদের মধ্যে এক ধরনের ভীতির সঞ্চার হচ্ছে। সারা বিশ্বেই এখন দেখা যাচ্ছে যে লোকজন তাদের কনুই দিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করছেন, সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠা বা নামার সময় রেলিং ধরছেন না এবং বাসে ট্রেনে চলার সময় হ্যান্ডল না ধরেই তারা দাঁড়িয়ে আছেন, অফিসে পৌঁছেই লোকজন জীবাণুনাশক দিয়ে তাদের ডেস্ক ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করছেন। যেসব এলাকায় এই ভাইরাসের মারাত্মক সংক্রমণ ঘটেছে সেখানে পরিবহন, রাস্তা ঘাট ও পার্কে স্প্রে করে সেগুলো জীবাণুমুক্ত করার চেষ্টা চলছে। একই উপায়ে পরিষ্কার করা হচ্ছে অফিস আদালত, হাসপাতাল, দোকানপাট, রেস্তোরাঁও। ড্রপলেটে কী থাকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির সময় তার নাক ও মুখ দিয়ে যে জলীয় কণা বা ড্রপলেট বাতাসে বের হয়ে আসে তার মাধ্যমে কোভিড-১৯ এর জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাত্র এক বারের কাশি থেকেই বের হতে পারে এরকম ৩,০০০ ড্রপলেট। ড্রপলেটের এই কণা গিয়ে পড়তে পারে আরেকজনের গায়ে, কাপড়ে এবং আশেপাশের জিনিসের উপর। তবে কিছু ক্ষুদ্র কণা থেকে যেতে পারে বাতাসেও। দেখা গেছে এই ভাইরাস মল-মূত্রের মধ্যে আরো বেশি সময় বেঁচে থাকতে পারে। টয়লেট থেকে ফিরে ভাল করে হাত না ধুলে তার হাতের স্পর্শের সাহায্যে আরো অনেক কিছুতেই এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন বলছে, ভাইরাসটি লেগে আছে এরকম কোন বস্তু স্পর্শ করার পর হাত দিয়ে যদি মুখ স্পর্শ করা হয় তাহলে ভাইরাসটি ছড়াতে পারে। তবে এটিই এই ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার প্রধান উপায় নয়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে অবরুদ্ধ ইতালি: রাস্তাঘাট ফাঁকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অন্যান্য কর্তৃপক্ষও বলছে যে, বার বার হাত ধুয়ে এবং একই সাথে যেসব জিনিস ধরা হচ্ছে সেগুলো বার বার জীবাণুমুক্ত করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব। করোনাভাইরাসের আয়ু এটা এখনও পরিষ্কার নয় যে কোভিড-১৯ এর জীবাণু মানবদেহের বাইরে কতক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে আরো যেসব করোনাভাইরাস আছে, যেমন সার্স ও মার্স, সেগুলো লোহা, কাঁচ এবং প্লাস্টিকের গায়ে ৯ (নয়) দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। আবার কোনো কোনো ভাইরাস ঠাণ্ডা জায়গায় ২৮ দিনও বেঁচে থাকতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথের একজন ভাইরোলজিস্ট নিলৎজে ফান ডোরমালেন তার সহকর্মীদের নিয়ে গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন কোভ-২ বা সার্স ভাইরাস কতক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে। তাতে দেখা গেছে, কাশি দেওয়ার পর থেকে ড্রপলেটের মধ্যে এই ভাইরাসটি তিন ঘণ্টা পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। ক্ষুদ্র ড্রপলেটে, যার আকার ১ থেকে ৫ মাইক্রোমিটার (মানুষের চুলের ৩০ গুন চিকন) সার্স ভাইরাস কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত বেঁচে থাকে। ড্রপলেট ছড়ানো বন্ধ করতে গাড়িতে প্লাস্টিক দিয়ে চালক ও যাত্রীকে আলাদা করা হচ্ছে। তবে গবেষণায় দেখা গেছে কোভ-২ ভাইরাস কার্ডবোর্ডের মতো শক্ত জিনিসের ওপর ২৪ ঘণ্টা আর প্লাস্টিকের জিনিসের গায়ে দুই থেকে তিন দিনও বেঁচে থাকতে পারে। গবেষণা বলছে, ভাইরাসটি দরজার হাতল, প্লাস্টিক ও লেমিনেটেড ওয়ার্কটপ ও কঠিন বস্তুর ওপর দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকতে পারে। আর কপারের কোন জিনিসে পড়লে এর মৃত্যু হতে চার ঘণ্টা সময় লেগে যেতে পারে। নির্মূলের উপায় গবেষণায় দেখা গেছে করোনাভাইরাসকে এক মিনিটেই নিষ্ক্রিয় করে ফেলা যেতে পারে। ৬২-৭১% এলকোহল মিশ্রিত তরল পদার্থ দিয়ে কোনো জিনিসকে করোনামুক্ত করা যায়। ০.৫ শতাংশ হাইড্রোজেন প্রিঅক্সাইড এবং ০.১% সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট মেশানো ব্লিচ দিয়েও করোনাভাইরাস নির্মূল করা সম্ভব। উচ্চ তাপমাত্রা ও আদ্রতার কারণেও অন্যান্য করোনাভাইরাসের দ্রুত মৃত্যু হতে পারে। দেখা গেছে সার্সের জন্যে দায়ী করোনাভাইরাস ৫৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় বেঁচে থাকতে পারে না। কতোক্ষণ বেঁচে থাকে কোভিড-১৯ এর জীবাণু বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোভিড-১৯ এর জন্যে দায়ী ভাইরাসটি কতক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে তা নির্ভর করে এটি কোন ধরনের বস্তুর গায়ে পড়েছে তার ওপর। দরজার শক্ত হাতল, লিফটের বাটন এবং কিচেন ওয়ার্কটপের মতো শক্ত জিনিসের গায়ে প্রায় ৪৮ ঘণ্টা টিকে থাকতে পারে। তবে এর আগের গবেষণায় দেখা গেছে সহায়ক পরিবেশে সব ধরনের করোনাভাইরাস এক সপ্তাহও বেঁচে থাকতে পারে। মার্সের জন্য দায়ী এই করোনাভাইরাস। তবে কাপড়ের মতো নরম জিনিসের গায়ে এটি এতো লম্বা সময় বেঁচে থাকতে পারে না। ফলে আপনি যে কাপড়টি পরেছেন এবং তাতে যদি ওই ভাইরাসটি থাকে, জামাটি একদিন কিম্বা দুদিন না পরলে সেখানে ভাইরাসটি জীবিত থাকার আর সম্ভাবনা নেই। মনে রাখতে হবে, কোভিড-১৯ এর ভাইরাসটি লেগে আছে এরকম জিনিসে শুধু স্পর্শ করলেই আপনি আক্রান্ত হবেন না। শুধু স্পর্শ করার পর আপনি যদি হাত দিয়ে মুখ, নাক অথবা চোখ স্পর্শ করেন তাহলেই এই ভাইরাসটি আপনার শরীরে ঢুকে পড়বে। তাই এই ভাইরাসটি প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ একটি করণীয় হচ্ছে হাত দিয়ে মুখ স্পর্শ না করা। একটা বিষয় এখন পর্যন্ত সকলের নিকটই পরিষ্কার ‘করোনা ভাইরাস’ আমাদের দেশেও ঢুকেছে এবং মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ছে শহর হতে অজপাড়া গাঁয়ে। প্রতিদিন খবরের পাতায় কারো না কারো আক্রান্তের খবর পাচ্ছি। এমন কি একজনের মৃত্যুও হয়েছে। দেশের সকল শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আজকে দেখলুম বিভিন্ন অঞ্চলে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বন্ধ। হাটবাজারে কি রকম একটা শূণ্যতা বিরাজ করছে। সব ধরনের পাবলিক গ্যাদারিং নিষিদ্ধ! মাসজিদগুলো মুসল্লি শূণ্য। আমরা লকড-ডাউন! এমতাবস্থায় আমাদের কি করা উচিত? আর আমরা করছি কী!? একজন মু’মিন কখনো আল্লাহ’র আযাবে খুশি হতে পারে না। আল্লাহ আযযা ওয়া জাল কখন আযাব নাযিল করে? যখন আল্লাহ’র জমিনে তাঁরই অবাধ্যতা বেড়ে যায়। মানুষগুলো দুনিয়ার চাকচিক্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আল্লাহ’র রাসূল (সাল্লাল্লাহু’ আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “যখন সমাজে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ছড়িয়ে পড়বে, তখন তাদের মধ্যে এমন রোগ-ব্যাধি ছড়িয়ে পড়বে যা ইতোপূর্বে দেখা যায়নি।” (ইবনে মাজাহ :৪০১৯) এমন নয় যে, আমরা সবাই আল্লাহ’র নাফরমানীতে লিপ্ত। এমনও বান্দা/বান্দি আছে যাদের সমস্ত চিন্তা জুড়েই সুমহান আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা’র ভালোবাসা। তারা নিয়মিত তাহাজ্জুদ গুজার যায়, প্রতিটি সময় আল্লাহ’র যিকির দ্বারা জিহ্বা ভিজিয়ে রাখেন। তাদের জন্য এই মহামারী (কভিট-১৯) কি তাহলে? “আমি অবশ্যই তোমাদেরকে কিছু না কিছু দিয়ে পরীক্ষায় ফেলবোই: মাঝে মধ্যে তোমাদেরকে বিপদের আতঙ্ক, ক্ষুধার কষ্ট দিয়ে, সম্পদ, জীবন, পণ্য-ফল-ফসল হারানোর মধ্য দিয়ে। আর যারা কষ্টের মধ্যেও ধৈর্য-নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করে, তাদেরকে সুখবর দাও।” (আল-বাক্বারাহ : ১৫৫) এক কথায় জবাব, তাদের জন্যে এই মহামারী পরীক্ষাস্বরূপ! আমরা প্রত্যেকেই এই পরীক্ষায় পাশ করে আল্লাহ সন্তুষ্টি অর্জন করায় সচেষ্ট থাকবো। নিঃসন্দেহে প্রত্যেক বিপদ-মুসিবত আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা’র হুকুম ব্যতীত আপতিত হয় না। “আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোন বিপদই আপতিত হয় না।..” (সূরাহ আত-তাগাবুন : ১১) আল্লাহ আযযা ওয়া জাল আরো বলেন, “মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তা’য়ালা তাদের কতিপয় কাজকর্মের জন্য তাদের শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাতে চান, যাতে করে তারা (সে কাজ থেকে) ফিরে আসে।” ( সূরাহ আর-রুম : ৪১) আল্লাহ আযযা ওয়া জাল এমনি এমনিই কোন আযাব দেন না, তিনি তো তার বান্দাদের তার দিকে ফিরে আসার আহ্বান করেন, এই সমস্ত আযাব আমাদের জন্য রিমাইন্ডার স্বরূপ আল্লাহ যেন বলতে চান— ও হে বিশ্বাসীরা আর কত আমাকে ভুলে পাপের মেকি সুখে নিজেদের ডুবিয়ে রাখবে। ফিরে এসো! “যে বিপদ-আপদই তোমাদের ওপর আসুক না কেন, তা হচ্ছে তোমাদের নিজেদের হাতের কামাই, আল্লাহ তা’য়ালা তো অনেক গুনাহ ক্ষমা করে দেন।” (সূরাহ আশ-শুরা : ৩০) নিজেদের কৃতকর্মের ফল নিজেদেরই ভোগ করতে হবে। এই আয়াতের শেষাংশটুকু খেয়াল করুন। আল্লাহ বলছেন তিনি অতি ক্ষমাশীল তিনি সব গুনাহ মাফ করে দেন। প্রিয় ভাই এবং বোনেরা আমরা আর কত কোরআনের কথাগুলোকে হালকাভাবে নিব? আল্লাহ আযযা ওয়া জাল তার বান্দাদের তাওবাহের জন্য ডাকছেন। আমরা তাওবাহ করি তাঁর দিকেই ছুটে চলি। বিপদ কিংবা মুসিবতের সময়ই নিজেদের ইমানকে স্ট্রং করতে হয়। দূর্বল ইমানের মানুষেরা বিপদে আল্লাহকে ভুলে যায়, তাদের তাওয়াক্কুল উঠে যায়। অপরদিকে মজবুত ইমান ওয়ালা মু’মিন বান্দা/বান্দিগুলো আল্লাহ’কে খুঁজে পায়। তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তিত হয়। করোনা ভাইরাস (কভিট-১৯) আমাদের জন্য আল্লাহ পক্ষ হতে একটি রিমাইন্ডার, একটি সুযোগ সেই চিরসত্য এক ইলাহকে চেনার। কারণ আল্লাহ বলেন, “বড়ো আযাবের আগে আমি অবশ্যই (দুনিয়ায়) ছোট খাটো আযাব আস্বাদন করাবো, হয়তো এতে (অনুতপ্ত হয়ে) সে আমার দিকে ফিরে আসবে।” (সূরাহ আস-সিজদাহ : ২১) আমাদের করণীয় : • প্লিজ সোস্যাল মিডিয়াতে ‘করোনা’ নিয়ে ট্রল করবেন না। নিঃসন্দেহে করোনা ভাইরাস আমাদের জন্য এক মহা মুসিবত। • বেশি বেশি তাওবাহ ইস্তেগফার করতে হবে। আল্লাহ ভয় অন্তরে স্থাপন করতে হবে। ওয়াক্তের সালাত মাসজিদে আদায় না করতে পারলেও বাসায় আদায় করে নিতে হবে। কারণ বিপদ আল্লাহ দিয়েছেন তা থেকে তিনিই উত্তোলন করবেন (ইন শা আল্লাহ) • বিপদ মুসিবতের সময় আল্লাহ’র রাসূল (সাল্লাল্লাহু’ আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কয়েকটি দো’আ পাঠ করতেন : ১. সাদ ইবনে আবি ওক্কাস (রা.) বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু’ আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুঃখ-কষ্টের সময় বলতেন : “লা-ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন।” (দোয়া ইউনূস) অর্থ : একমাত্র তুমি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। নিশ্চয়ই আমি সীমালঙ্ঘনকারী। (তিরমিজি : ৩৫০০) ২. আসমা বিনতে ওমাইর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু’ আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আমি কি তোমাদের এমন কিছু শিখিয়ে দেব না যা তুমি দুশ্চিন্তা ও পেরেশানির মধ্যে পড়বে। সাহাবী বললেন, অবশ্যই শেখাবেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু’ আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, দোয়াটি হচ্ছে : “আল্লাহু আল্লাহ রব্বী লা উশরিকু বিহি শাইয়ান।” অর্থ : আল্লাহই আল্লাহ আমার প্রতিপালক। আমি তার সঙ্গে কোনো কিছু শরিক করি না। (আবু দাউদ : ১৫২৫) ৩. আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু’ আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : “আল্লাহুম্মা লা সাহলা ইল্লা মা জায়ালতাহু সাহলান, ওআনতা তাজআলুল হুযনা সাহলান ইযা শিইতা।” অর্থ : ইয়া আল্লাহ, কোনো বিষয় সহজ নয়। হ্যাঁ, যাকে তুমি সহজ করে দাও। যখন তুমি চাও তখন তুমি মুশকিলকে সহজ করে দাও। (ইবনে হিব্বান : ৯৭৪) আল্লাহ আমাদের এই মুসিবত থেকে হেফাযত করুন। তাঁর দিকে টেনে নিক, আমাদের তাঁর ও তাঁকে আমাদের বানিয়ে নিক। আল্লাহুম্মা আমীন! আল্লাহ তাআলার আদেশ মেনে চলা ও তাঁর নিষিদ্ধ বিষয়গুলো থেকে বেঁচে থাকতে চাইলে একজন মুসলিমকে যে বিষয়ে বিশেষভাবে মনোযোগী হওয়া উচিৎ, তা হল তার প্রাত্যহিক রুটিন৷ একজন মুসলিম কখন ঘুম থেকে উঠবে, রাতে কখন বিছানায় যাবে – এ সকল বিষয়ে ইসলামের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে৷ হাদীসে বর্ণিত: “সাখর আল গামিদী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেছেন: হে আল্লাহ আপনি দিনের অগ্রভাগে আমার উম্মাতের জন্য বরকত দিন৷ এবং তিনি যখন কোন ছোট বাহিনী কিংবা বড় দলকে অভিযানে পাঠাতেন, তাদের দিনের অগ্রভাগে পাঠাতেন৷ আর সাখর একজন ব্যবসায়ী ব্যক্তি ছিলেন৷ তিনি দিনের প্রথমভাগ থেকেই ব্যবসা পরিচালনা করতেন, ফলে তিনি ধনাঢ্য হয়ে ওঠেন এবং তার সম্পদ বৃদ্ধি পায়৷“ [1] এই হাদীস থেকে জানা যায় যে এই উম্মাতের মধ্যে কল্যাণ রয়েছে দিনের অগ্রভাগে৷ অতএব ফজরের সালাতের পর না ঘুমিয়ে যিকরে মশগুল থাকা এবং সূর্যোদয়ের কিছুক্ষণ পর দুই রাকাত নফল সালাত আদায় করে এরপর কাজে নেমে পড়া মুসলিমদের জন্য বরকত তথা কল্যাণ বৃদ্ধি ও স্থায়ীত্বের কারণ হবে৷ আর যে ফজরের সালাতের সাথে সাথেই দিনের শুরু করতে চায়, তাকে রাতে আগেভাগেই বিছানায় যেতে হবে৷ এজন্য আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এশার সালাতের পর কথাবার্তা বলা পছন্দ করতেন না৷ তিনি ও তাঁর সাহাবীগণ এশার পরপর রাত্রির অগ্রভাগেই বিছানায় যেতেন, যেন শেষরাত্রিতে জেগে উঠে তাহাজ্জুদ আদায় করতে পারেন; অথবা অন্ততপক্ষে যেন ফজরের সালাতের সময় সতেজ দেহমন নিয়ে জেগে উঠতে পারেন৷ হাদীসে বর্ণিত: “আর তিনি [রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] এশা বিলম্বিত করাকে পছন্দ করতেন,…আর তিনি এর পূর্বে ঘুমকে এবং এর পরে কথাবার্তাকে অপছন্দ করতেন৷” [2] আজ বহু মুসলিম পরিবারেই এর বিপরীত অভ্যাস দেখতে পাওয়া যায়৷ অনেকেই গভীর রাত পর্যন্ত রাত্রিজাগরণে অভ্যস্ত। তাদের অনেকেই ফজরের সালাত ঘুমিয়ে পার করে দেন৷ অনেকে রাত জেগে টেলিভিশন দেখে, ইন্টারনেটে ব্রাউজ করে কিংবা গল্পগুজব করে সময় কাটান, আর এগুলোর মাধ্যমে তারা বিভিন্ন ধরনের গুনাহে লিপ্ত হন৷ অনেক ছাত্রদের ধারণা যে রাত জেগে লেখাপড়া করলে ভাল ফল পাওয়া যায়৷ কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ বিপরীত৷ কেউ রাত্রিতে যথেষ্ট ঘুমিয়ে ভোরে উঠে সতেজ দেহ-মন নিয়ে দু-ঘন্টায় যতটুকু পড়া করতে পারবে, তা হয়ত রাত জেগে চার ঘন্টা লেখাপড়ার সমান৷ অনেকে অভিযোগ করেন যে রাত্রি জাগরণ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, আর এ অভ্যাস পরিবর্তন করা সম্ভব হচ্ছে না৷ এই অভ্যাস পরিবর্তনের সহজ উপায় আছে৷ কষ্ট করে কয়েকদিন ফজরের সময় ঘুম থেকে জেগে ওঠা এবং ফজরের সালাতের পর আর বিছানায় না যাওয়ার অনুশীলন করলে প্রথমে কষ্ট হলেও শীঘ্রই এটা অভ্যাসে পরিণত হবে৷ ফজরের পর ঘুম তাড়িয়ে রাখার জন্য প্রথমদিকে কিছু খেলাধূলা বা শারীরিক পরিশ্রম করা যেতে পারে৷ প্রয়োজনে অভ্যাস পরিবর্তনের জন্য ছুটির সময়কে বেছে নেয়া যেতে পারে, যেন তা করতে গিয়ে কাজের ক্ষতি না হয়৷ মোটকথা ঘুমের অভ্যাস পরিবর্তন করা সম্ভব – এটি পরীক্ষিত৷ দৈনন্দিন রুটিনের মধ্যে আরও থাকতে পারে দিনের শেষভাগে খেলাধূলা ও শরীরচর্চা৷ সাহাবীগণ দিনের শেষভাগে, এমনকি মাগরিবের সালাত আদায় করেও তীর-নিক্ষেপ চর্চা করতেন৷ দিনের শেষভাগে কিছুটা শরীরচর্চা, হাঁটা বা খেলাধূলা করা রাত্রিতে ঘুমকে গভীর করতে সহায়ক হবে৷ এছাড়া দৈনন্দিন রুটিনের মধ্যে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত তো আছেই – যার প্রতি বিশেষ যত্নবান হওয়া প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য-কর্তব্য৷ দৈনন্দিন রুটিনের মধ্যে আরও থাকা দরকার নিয়মিত দ্বীন-শিক্ষা ও কুরআন চর্চা৷ হঠাৎ বেশি পরিমাণে কোন আমল করার চেয়ে অল্প হলেও নিয়মিত আমল করাটা অধিক উপকারী এবং আল্লাহর কাছে বেশি পছন্দনীয়৷ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “আল্লাহর কাছে সবচেয়ে পছন্দনীয় সে সমস্ত আমল, যা অল্প হলেও নিয়মিত করা হয়৷” [3] তেমনি দৈনন্দিন রুটিনের মধ্যে থাকা উচিৎ নিকটাত্মীয়, বিশেষভাবে মা-বাবার খোঁজখবর নেয়া, তাঁদের প্রয়োজন পূরণ করা৷ এছাড়া স্ত্রী এবং সন্তানদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে সময় বরাদ্দ থাকা দরকার৷এই সমস্ত দিকনির্দেশনা মেনে প্রাত্যহিক রুটিন ঠিক করে নিয়ে তা অনুসরণ করলে একজন মুসলিম সহজেই যাবতীয় পাপাচার থেকে বেঁচে থাকতে পারবে এবং আল্লাহ তাআলার আনুগত্য করা তার জন্য সহজতর হবে ইনশা আল্লাহ৷ [1] আহমদ ও সুনান গ্রন্থসমূহের প্রণেতাগণ কর্তৃক বর্ণিত৷ [2] বুখারী, মুসলিম৷ [3] বুখারী, মুসলিম৷
Reactions

Post a Comment

0 Comments